মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রেখে কিভাবে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব?
How is Suicide Prevention possible keeping Good Mental Health? Author : Dr. Jakir Hossain Laskar, PhD প্রায় সমস্ত দেশেই প্রথম দশটি মৃত্যুর কারনের মধ্যে আত্মহত্যা একটি। প্রতি পাঁচজন মানুষের মধ্যে একজন জীবনের কোনও না কোনও সময়ে আত্মহননের কথা ভাবেন। আত্মহত্যা কোনও অপরাধ নয় -মনের এক গভীর অসুখ। এর নিবারণে ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবসে সমাজের সর্বস্তরের জনগণকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে লিখেছেন ডাঃ জাকির হোসেন লস্কর। আধুনিক বিশ্বে সর্বব্যাপী নৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের জন্যে সুস্থ মানসিক চিন্তাশক্তি ক্রমে ক্রমে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে আমাদের জীবনচর্যা থেকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আর সদর্থক মূল্যবোধগুলো তিল তিল করে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ঘরে-বাইরের প্রবল মানসিক চাপে মানসলোকের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে আমরা চূড়ান্ত নেতিবাচক পরিমানের শিকার হচ্ছি। ফলশ্রুতিতে কেউ কেউ বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার অন্ধকূপ। বিশ্বজুড়ে আত্মহত্যার পরিসংখ্যান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, কম-বেশি ৪০-৪৫ কোটি মানুষ সারা বিশ্বে বর্তমানে মানসিক অবসাদের শিকার। বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর ১০ লক্ষেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেন। আর আত্মহননের চেষ্টা করেন প্রায় ২ কোটি মানুষ। তথ্য প্রমান থেকে জানা যাচ্ছে, প্রতিদিন কম-বেশি ৪-৫ হাজার নারী-পুরুষ অসহনীয় মনসিক অবসাদের কারণে আত্মহত্যার চূড়ান্ত পথ বেছে নেন। মানসিক অবসাদের চাপে চুরমার হয়ে যাচ্ছে আমাদের ব্যাক্তিগত জীবনের আশা-আকাঙ্খাগুলো, ভেঙ্গে যাচ্ছে সুস্থ মানবিক সম্পর্ক। লেখাপড়ার চাপে বর্তমানে ছাত্রছাত্রীরা ক্লান্ত ও অবসন্ন। জীবন ও জীবিকার চাপে তাদের বাবা মায়েরাও আজ বিধ্বস্ত এবং অবসাদগ্রস্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট বলছে, ২০২৫-২০৩০ সালের মধ্যে ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজের পরে দ্বিতীয় স্থানটি দখল করবে মেন্টাল ডিপ্রেশন বা মানসিক অবসাদ নামক রোগটি। ক্যানসার, এইডস্ ইত্যাদি নানান মারনব্যাধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এদের সবাইকে পরাস্ত করে ২০৩৫ সালের মধ্যে এই মানসিক অবসাদ রোগের আনুপাতিক গুরুত্বের বিচারে প্রথম স্থানটি দখল করতে চলেছে। বর্তমান শতাব্দীতে সর্বগ্রাসী অবসাদের প্রভাবে আত্মহত্যার প্রবনতা যেভাবে মহামারীর আকার নিচ্ছে, দুনিয়াজোড়া সেই সংকটকে মাথায় রেখে ২০১৭ সালে বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবসের (১০ সেপ্টেম্বর) স্লোগান রাখা হয়েছে – ‘টেক আ মিনিট, চেঞ্জ আ লাইফ’ অর্থাৎ সামান্য সহমর্মিতা ও সমবেদনা জ্ঞাপনের মাধ্যমে আত্মহত্যার মরনফাঁদ থেকে একজন মানুষকে বাঁচানো যায়। মানসিক অবসাদ চিনবেন কী করে অবসাদের কবলে পড়ে মানুষ চূড়ান্ত হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। দৈন্দনিন কাজকর্মের আগ্রহ কমে যায়। আনন্দ পাওয়ার অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যাওয়ার কারণে কোনও কিছুই আর একদম ভালো লাগে না। রোগীর মনের অবস্থা এতটাই নেতিবাচক হয়ে ওঠে যে, তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন, এই হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতির আর কিছুতেই পরিবর্তন হবে না। সব কিছুতেই খিটখিটে মেজাজ, বিরক্তিভাব, ভিতরে ভিতরে চূড়ান্ত অস্থিরতা গ্রাস করে। অসম্ভব ক্লান্তি ভাব, কোনও কাজে মনঃসংযোগ ধরে রাখতে পারে না। জীনবে ঠিকঠাক সিদ্ধান্ত নিতেও ভূল করে বসে। সারাদিন শুয়ে বসে কাটাতে মন চায়। খিদে ও পিপাসা কমে যায়। রাতে ছটফট করে, ভালো করে ঘুমাতে পারে না। রোগী বিশ্বাস করতে শুরু করে, তারই দোষে সংসারের আজ এই হাল। ভাবতে থাকে, আমি মরে গেলে সংসারের সবার কল্যাণ হবে, মঙ্গল হবে। কেউ কেউ মৃত্যুচিন্তায় উদ্বেল হয়ে ওঠেন। ভাবেন, কোনও মতে এ পৃথিবী থে কে বিদায় নিতে পারলে আমার শান্তি। রোগী যখন অবসাদগ্রস্ত অবস্থা আর সহ্য করতে পারে না, তখন আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে পড়ে। তখন তাঁর ভিতরকার অস্থিরভাব হঠাৎ করে স্তিমিত হয়ে আসে। তখন এমনকী তাঁরা নিজের প্রিয় জিনিসটিও অন্যকে ডেকে দিয়ে দেন। মানুষ কী কারণে ও কেন আত্মহত্যা করে ব্যক্তিত্বের বিকার থেকে মানুষ যখন তাঁর সহজাত জৈবিক চাহিদাগুলোকে পরিপূর্ণ করতে ব্যর্থ হয়, তখন ধীরে ধীরে তাঁর মধ্যে দেখা দেয় বিষণ্ণতা, হতাশা, অপরাধবোধ, উৎসাহহীনতা, কর্মবিমুখতা ও আত্মহননের ইচ্ছে। ধর্মীয় ও নানারকম আর্থ-সামাজিক কারনে মানসিক অবসাদ আমাদের গ্রাস করে, আমাদের মনের আকাশ ছেয়ে যায় অবসাদের কালো মেঘে। বেকারত্ব, দারিদ্র, ঋণগ্রস্ত অবস্থা, সাম্প্রতিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে ক্রমাগত মানসিক চাপ, বৈবাহিক জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি ও দাম্পত্যকলহ অবসাদের কারন হয়ে দেখা দেয় ও পরিণতিতে আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটতে থাকে। একাকীত্ব-জনিত নিঃসঙ্গতা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের অবসাদের অন্যতম কারণ। পারিবারিক বা অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অভাববোধ থেকে বৃদ্ধ বয়সে অনেকেই মনোবিকার বিশেষত মানসিক অবসাদের কবলে পড়েন। ছেলে-বউমার সংসারে স্বাধীনতাহীন অবস্থায় বেঁচে থাকার যন্ত্রণায় বেশি বয়সের অবসাদগ্রস্ত অবস্থা আত্মহত্যার কারন হয়ে দেখা দেয়। দীর্ঘকাল যন্ত্রণা ও বেদনাদায়ক কঠিন অসুখে ভুগলে অবসাদ আসে। মদ্যপান, ড্রাগ ইত্যাদি নেশার সামগ্রী অত্যধিক সেবনে অবসাদ দেখা দেয়। মাদকাসক্তের মধ্যে তাই মানসিক অবসাদের কারনে আত্মহত্যার প্রবনতা বেশি। ‘স্মাইলিং ডিপ্রেশন’ নামের একটি শব্দবন্ধ অনেকেই হয়ত শুনে থাকবেন। অনেক ডিপ্রেশনের রোগী থাকেন যারা অবসাদ লুকিয়ে বাইরে হাসিমুখে থাকেন, রাস্তায় দেখা হলে জিজ্ঞাসা করলে বলেন – তিনি সুখে ও আনন্দে আছেন। আত্মহত্যা জাতীয় কোনও মারাত্মক অঘটন না ঘটলে বোঝাই যায় না যে তিনি আসলে কতটা অবসাদগ্রস্ত ছিলেন। এছাড়া, ব্যক্তির কামনা-বাসনার সঙ্গে তাঁর প্রকৃত সামর্থের সামঞ্জস্য না থাকলে মানসিক অবসাদ দেখা দিতে পারে। বর্তমান যুগে সর্বাত্মক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয় আমাদের অন্ধকার জগতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। নানাবিধ অবক্ষয়ের প্রকোপে আমাদের সন্তান-সন্ততিরা বিকৃতির দীক্ষা পেয়ে যাচ্ছে। তাদের অবচেতন মনে গৃহীত সেইসব বিকৃতির প্রভাবে ক্রমশ তারা উৎকণ্ঠা ও উত্তেজনায় উথালপাথাল হতে থাকে। মানসিক এই স্বাস্থ্যহানির কারণে কেউ কেউ অপরাধপ্রবণ হয়ে অবশেষে অসামাজিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়। কেউবা আবার বাস্তব থেকে পালিয়ে কল্পনার জগতে বাস করতে করতে স্কিজোফ্রেনিয়ায় (অলীক কাল্পনিক বাতুলতা রোগবিশেষ) আক্রান্ত হয়ে পড়ে। অনেকে আবার না পাওয়ার হতাশা-জনিত কারণে মানসিক বিষণ্ণতায় আত্মহননের পথ বেছে নেয়। আত্মহত্যা সংক্রান্ত জ্ঞাতবা কিছু তথ্য ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরো-র রেকর্ড অনুযায়ী আমাদের দেশে ২০০৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে সর্বাধিক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। সরকারি তথ্য প্রমাণ অনুযায়ী, ভারতবর্ষে প্রতি বছর ৭০ থেকে ৭৫ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী পুরুষদের মধ্যে আত্মহননের ঘটনা নারীদের তুলনায় তিনগুণ বেশি। আর নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার চেষ্টা করার প্রবনতা পুরুষদের তুলনায় চারগুণ বেশি। বিবাহিত দম্পতিদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবনতা তুলনামূলক কম, পক্ষান্তরে বয়স্ক অবিবাহিত, বিধবা বা বিপত্নীকদের মধ্যে আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে অবশ্য বিবাহ-বিচ্ছিন্নাদের ক্ষেত্রে। বর্তমানে ছাত্রছাত্রী, পুলিশকর্মী ও সেনা জওয়ানদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা প্রচণ্ড হারে বাড়ছে। মনোরোগ গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, যাঁরা আত্মহত্যা করেছেন তাঁদের মধ্যে ৬০-৬৫ শতাংশ মানুষ আত্মহত্যা করার আগে মনোচিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন এবং আকার-ইঙ্গিতে নিজের জীবন নিয়ে হতাশার কথা ডাক্তারবাবুকে জানিয়েছিলেন। আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষজন মৃত মানুষদের নিয়ে বারংবার আলোচনা করতে পছন্দ করেন, মানুষ কীভাবে মারা যায় তা নিয়েও আলাপ-আলোচনা করতে ভালোবাসেন। তাঁর মধ্যে হঠাৎ করে চুপচাপ একা থাকার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কালক্রমে অবসাদ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছলে মানুষ আত্মহত্যার কথা ভাবে। আত্মহত্যা নিবারণে আমাদের সামাজিক দায়িত্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধে আমাদের অনেক কিছু করণীয় আছে। মানসিক অবসাদ কাটাতে কোনও কথাই নিজের মধ্যে গোপন করে রাখবেন না। সমমর্মী কাউকে আপনার মানসিক দুরবস্থার অংশীদার করে নিন। অবসাদে নিমজ্জিত ও হৃদয় মননে জর্জরিত মানুষকে বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা সবাই তাঁর পাশে আছেন ও তাঁর বিষণ্ণতা ও অবসাদের কারন অনুসন্ধান করে, তার থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে নিকট আত্মীয় পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা সকলে ঐকান্তিক প্রয়াস করছেন।